
অক্সফোর্ডে বক্তব্যের মাঝে বামপন্থীদের বিক্ষোভ, মাথা ঠান্ডা রেখে বিক্ষোভকারীদের ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে বোঝালেন মুখ্যমন্ত্রী
অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজের মঞ্চে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিল। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন ও সামাজিক প্রকল্প নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন তিনি। কিন্তু সেই বক্তৃতার মাঝেই শুরু হয় বিরোধিতা। বামপন্থী শ্রোতাদের একাংশ চিৎকার করে বলতে থাকে, “মিথ্যে বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় !” কেউ প্রশ্ন তোলে টাটার বিনিয়োগ না-করা নিয়ে, কেউ তোলেন আরজি কর প্রসঙ্গ । মুহূর্তেই সভায় ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। কিন্তু চিরাচরিত ভঙ্গিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিস্থিতিকে একেবারে অন্যভাবে সামলালেন। বামপন্থী বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেন, “ইফ ইউ মিস দ্য ট্রেন আই অ্যাম অন, ইউ উইল নো দ্যাট আই অ্যাম গন !” অর্থাৎ আমি যে ট্রেনে রয়েছি, আপনি সেটি মিস করেছেন, তাই আপনি বুঝতে পারবেন না, আমি কোথায় চলে গিয়েছি ! তিনি স্পষ্ট করে দেন-এই বিক্ষোভ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারবে না, বরং তিনি মানুষের জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার সময় যখন এই ঘটনাটি ঘটে, তখন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। যখন উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন তিনি শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলেন, “আপনারা তো নিজেদের প্রতিষ্ঠানকেও অসম্মান করছেন। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু এখনও বিনম্র রয়েছি ।” বামপন্থী বিক্ষোভকারীদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বাংলায় এসে দেখে যান, আমি মিথ্যে বলছি না। এই মঞ্চকে রাজনীতির জায়গা বানাবেন না।” বিক্ষোভকারীদের ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান মুখ্যমন্ত্রী ৷ এমনকি, বিরোধীদের কথায় দমে না-গিয়ে তিনি রীতিমতো বিদ্রুপের সুরে বলেন, “আমি খুশি, ফিরে গিয়ে তোমাদের মিষ্টি পাঠাব !” এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হলেও, মমতা ফের বুঝিয়ে দিলেন-তিনি সেই লড়াকু নেত্রী, যিনি সহজে হার মানেন না। তিনি বলেন, “আমি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে জানি। আমি পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নই। এবার থেকে চেষ্টা করব প্রতি বছর আসতে।” এরপর রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য…’ ৷ এর পর মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দেন, তিনি হিংসায় বিশ্বাস করেন না, বরং শান্তির মধ্য দিয়েই সব জয় করা সম্ভব। শেষে অক্সফোর্ডের সঞ্চালকরা সভার সাময়িক বিশৃঙ্খলার জন্য ক্ষমা চান। তাঁরা প্রশ্ন করেন, প্রশাসন, দল সামলেও ১৩০টি বই লেখার মতো অফুরন্ত শক্তি তিনি কোথা থেকে পান ? মমতা হাসতে হাসতে বলেন, “মা-মাটি-মানুষই আমার শক্তি । মা মানে আম্মা, মাটি মানে সয়েল আর মানুষ মানে পাবলিক অর্থাৎ জনতা।” রসিকতার সুরে বলেন, “মাই টাইটেল ইজ ব্যানার্জী, অপোজিট অফ এনার্জি !” অক্সফোর্ডের মঞ্চে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে অনেকেই ভেবেছিলেন হয়তো উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথা ঠান্ডা রেখে, কখনও গান গেয়ে, কখনও কবিতা উদ্ধৃত করে প্রমাণ করলেন, তিনি শুধু রাজনীতিক নন, একজন দক্ষ কৌশলীও।
অক্সফোর্ডের বক্তৃতাঃ
কেলগ কলেজের হাউসফুল প্রেক্ষাগৃহে ‘হাইভোল্টেজ’ বক্তব্য রাখলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । সামাজিক উন্নয়ন ও নারী ক্ষমতায়নে বাংলা কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তা অক্সফোর্ডকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন তিনি। নিজের জীবনে লড়াইয়ের প্রসঙ্গ থেকে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, ‘ন’বছর বয়সে বাবাকে হারানোর সময় থেকে আমার লড়াই শুরু হয়েছিল। আমি বিরোধী দলনেত্রী থাকাকালীন লড়াই করেছি। কেন্দ্রে রেল-কয়লা-নারী ও সমাজ কল্যাণ এবং ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলাম। ৩৪ বছরের সিপিএমের শাসনের পর আমরা ১৫ বছর সরকারে আছি’। তাঁর কথায় উঠে এল মা-মাটি-মানুষের প্রসঙ্গও। জানালেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছাত্র থেকে ছাত্র, কৃষক থেকে কৃষক মহিলা থেকে মহিলা সবার মধ্যে যেন সমতা থাকে। সবাইকে যেন সমান চোখে দেখা হয়। কারণ, সবাই মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব মানুষের পাশে থাকা। আমরা কন্যাশ্রী চালু করেছি ছাত্রীদের জন্য। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এখনও পর্যন্ত ১ কোটি ছাত্রী কন্যাশ্রী পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পর তাঁরা স্মার্ট কার্ড পান। সেখান থেকে তাঁরা বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পান। অর্থের অভাবে যারা পড়াশোনা করতে পারেন না তাদের জন্য আমরা আছি। ৯৯.৫% পড়ুয়ার কাছে আমরা শিক্ষা পৌঁছে দিয়েছি। এক বছরে সেটা ১০০% হয়ে যাবে। ছাত্রীদের পাশাপাশি ছাত্র, আদিবাসীদের জন্য প্রকল্প রয়েছে। আমাদের ছাত্ররা অত্যন্ত প্রতিভাবান। তবে তাদের স্কলারশিপ দরকার। কখনও কখনও তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতে হয়। আমরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালু করেছি। মহিলাদের যাতে নিজস্ব কিছু সঞ্চয় থাকে। সেটা তাঁরা নিজেদের মতে করে খরচ করতে পারবেন। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আমাদের বাংলায় সবই বিনামূল্যে। প্রত্যেক মাসে মহিলাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দেওয়া হয়। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন এই টাকা পাবেন। কৃষকরাও পেনশন পান। ‘বাংলার বাড়ি’ আমরা বিনামূল্যে দিই গরীবদের’। কোভিডের পর বিশ্বজুড়ে একটা অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তার কবলে পড়তে হয়েছিল বাংলাকেও। সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে মমতা জানান, ‘বাংলায় সব ধরনের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করেন। অনেকে চাকরির সূত্রে চলে আসেন। বাংলায় বর্তমানে ১১ কোটি জনসংখ্যা। ভারতে অনেক রাজ্যের মধ্যে কোনোটা বড়, কোনোটা ছোট রাজ্য। গুজরাট অনেক বড় রাজ্য হলেও সেখানে জনসংখ্যা বাংলার তুলনায় অনেক কম। আমাদের রাজ্য সবাই একসঙ্গে থাকে। এই ঐক্য বজায় রাখা কঠিন কাজ’। হলে উপস্থিত অতিথিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কথায় উঠে আসে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, শেক্সপিয়রের কথাও। পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণের নামও শোনা যায় তাঁর মুখে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘দেশের মধ্যে বর্তমানে কলকাতা চাকরির অন্যতম বড় ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, কলকাতা বর্তমানে এআই হাব, এডুকেশন হাব, হসপিটাল হাব, ডেটা সেন্টার হাব। ব্রিটিশদের সময় কলকাতা দেশের রাজধানী ছিল। এখন বাংলা দেশের সংস্কৃতির রাজধানী’।