পাক অধিকৃত কাশ্মীর ফেরানোর সুযোগ হাতছাড়া হলঃ মুখ্যমন্ত্রী

অপারেশন সিঁদুরের সময় পাকিস্তানের আর্জি মেনে নিয়ে চারদিনেই লড়াই থামিয়ে দেয় ভারত ৷ পাকিস্তান কোনও আক্রমণ না-করলে, আর প্রত্যাঘাত হবে না বলেও ভারতের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয় ৷ কেন তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, মঙ্গলবার কার্যত সেই প্রশ্ন তুললেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তাঁর মতে, এবার পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের অধীনে আনার সুযোগ ছিল ৷ তা হাতছাড়া হয়েছে ৷ অপারেশন সিঁদুরে ভারতীয় সেনার বীরত্ব নিয়ে প্রশংসাসূচক প্রস্তাব এদিন পেশ হয় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ৷ সেই প্রস্তাবে বক্তব্য রাখেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ সেখানেই অপারেশন সিঁদুর নিয়ে এই মন্তব্য করেন তিনি ৷ পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ থেকে পহেলগাঁওয়ের হামলা, বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ পাক অধিকৃত কাশ্মীর কেন ফেরানো গেল না ! পহেলগাঁওয়ের হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গিদের কেন ধরা গেল না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল । জঙ্গি হামলার পর এতগুলো দিন ঘটে গেল কেন এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিদের গ্রেফতার করা গেল না । এটা কি কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা নয় ?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যেভাবেই হোক এই জঙ্গিদের ধরে আনা হোক ।’’ তারপর মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, ‘‘এবার তো সুযোগ ছিল পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে আমরা ফেরত আনতে পারতাম । কেন তা করা গেল না ?’’ পহেলগাঁওতে ধর্ম জেনে হত্যা করা হয়েছিল কি ! পহেলগাঁওতে বেছে বেছে হিন্দু পর্যটকদের খুন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ৷ এদিন সেই নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদের কোনও জাত-ধর্ম হয় না । তিনি বলেন, ধর্ম জিজ্ঞাসা করে মারা হয়েছে কি না জানি না । তবে মৃত পরিবারদের কেউ কেউ একথা বলেছে ।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সবচেয়ে বড় কথা বলা ভালো, ট্যুরিস্টদের উপর অত্যাচার হয়েছে । খুন হয়েছে । শুধু শোক জানিয়ে ছোট করে ব্যাপারটা শেষ হয় না । তাঁদের পরিবারকে সমবেদনা জানাই । এখানেও আমাদের বাংলা তিনজন আছে, যাঁরা এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন ।’’ সেদিন পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে স্থানীয় এক কাশ্মীরি যুবক নিহত হন ৷ সেকথাও এদিন মুখ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন ৷ তিনি বলেন, ‘‘একইভাবে এখানে হিন্দুদের বাঁচাতে গিয়ে একজন সংখ্যালঘু প্রাণ দিয়েছে, তাঁকেও কুর্নিশ জানাতে হবে ।’’ পহেলগাঁও-এর হানা শুধু গোয়েন্দা ব্যর্থতা নয় ! গত 22 এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরণ ভ্যালিতে 26 জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা ৷ সেই জঙ্গিদের মধ্যে একজন স্থানীয় ছিলেন ৷ বাকিরা পর্যটক ৷ এই ঘটনাকে গোয়েন্দা ব্যর্থতা হলেই শুরু থেকে তোপ দাগছিলেন বিরোধীরা ৷ কিন্তু এটাকে শুধু গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলতে নারাজ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ৷ এদিন বিধানসভায় তিনি বলেন, ‘‘পহেলগাঁওয়ের ঘটনা শুধুমাত্র ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা নয় । সামগ্রিকভাবে ভারত সরকারের ব্যর্থতা । বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স থেকে পুলিশ সর্বস্তরের ব্যর্থ হয়েছে । ভুলে গেলে চলবে না জম্মু-কাশ্মীরের পুলিশও কেন্দ্রের হাতে । কেন এই ঘটনা ঘটার পর দীর্ঘ সময় সেখানে পুলিশকে দেখতে পাওয়া গেল না ? কেন পাওয়া যায়নি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে ? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি ভারতীয় তিন বাহিনীর জওয়ানদের পুরোপুরি সম্মান জানাচ্ছি । ভারতীয় জওয়ানদের সম্মান জানিয়েও আমি বলব, কেন্দ্রীয় সরকারের আরও শক্ত হওয়া উচিত ছিল । ইন্টার্নাল (অভ্যন্তরীণ), ইন্টারন্যাশনাল (আন্তর্জাতিক) ও ন্যাশনাল (জাতীয়) – সবস্তরের সিকিউরিটি ফেল করেছে । কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা এটা ।’’ মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘কেন আপনাদের কাছে খবর ছিল না ! পুলওয়ামার ঘটনা ঘটার পর রাজ্যপালও (জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক) সতর্ক করে দিয়েছিলেন । সেই সময় তিনি বারবার জানানোর পরেও অ্যাকশন নেওয়া হয়নি ।’’ সিঁদুর পরানোর অধিকার প্রধানমন্ত্রীর নেই ! এদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিশানা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি বলেন, ‘‘পহেলগাঁওয়ে মানুষ গুলি মারা গিয়েছে, সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরেছে । কেউ কেউ আবার বাজার করতে বেরিয়েছে । বিভিন্ন দেশে কেন আর্মি অফিসারদের পাঠানো হল না । যখন বিরোধী দল সারা পৃথিবী ঘুরে দেশের ঐক্যের কথা বলছে, আপনি নিজের প্রচার করে বেরাচ্ছেন ।’’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘আমরা সিঁদুরকে সম্মান করি । মা-বোনেরা যে সিঁদুর পরে, সেই সিঁদুর । এটাকে তাঁরা সারা জীবনের সাথী হিসেবে মনে করে রাখেন । এই সিঁদুর তাঁদের স্বামীরা পরায় । আপনার এই সিঁদুর পরানোর হক নেই । এতে আপনি মহিলাদের অসম্মান করছেন ।’’ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যেখানে হামলা হয়েছে, সেখানে আপনি একবারও গিয়েছেন । প্রধানমন্ত্রী যাননি । পুঞ্চ-রজৌরিতে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ! অথচ এই নিয়ে প্রচার করে বেরাচ্ছেন । জন্ম থেকে মৃত্যু শুধু নিজের ফটো এই নিয়ে দেশ চলবে না ।’’ পহেলগাঁও পরবর্তী পরিস্থিতি ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডাকা উচিত ছিল বলেই মনে করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদের যেকোনও একটা ঘটনা ঘটলে আপনার তো হাউসকে কৈফিয়ত দেওয়া উচিত । আপনি কেন হাউসকে জবাবদিহি করছেন না ।’’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিদেশমন্ত্রীকে বাইরে পাঠানো উচিত ছিল । আর্মি প্রধানদের বাইরে পাঠানো উচিত ছিল । আপনার মিনিস্টারদের পাঠানো উচিত ছিল । যে কাজটা আপনাদের করার কথা ছিল, সেটা আপনারা করতে পারেননি ৷ করেছে বিরোধী দল । আমি বিরোধী দলকে স্যালুট জানাই ৷ তারা রাজনীতি না করে বিদেশে গিয়ে দেশের হয়ে কথা বলছেন । আর আপনি নিজে না-গিয়ে দেশে ভোটের প্রচার করে বেরাচ্ছেন । নির্বাচনের জন্য পুলওয়ামা যেন না-হয় ! 2019 সালের 14 ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা হয়েছিল ৷ সেই নিয়ে ফের সরব হলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ এদিন বিধানসভায় তিনি বলেন, ‘‘পুলওয়ামা দেখে আমরা অনেক শিক্ষা পেয়েছি । কীভাবে রাজনীতি হয়েছে । সুতরাং নির্বাচনে এলেই একটা পুলওয়ামা করতে হবে, এমন যেন আর না-হয় । পহেলগাঁও দেখে আমরা আবার বলছি, দেশে এই ধরনের সন্ত্রাসবাদের ঘটনা যেন আর না-ঘটে ।’’ তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদ রুখতে কেন্দ্রীয় সরকার ফেল করেছে । এই সরকারের বিদায় নেওয়া উচিত । আপনাদের পদত্যাগ করা উচিত । দেশের মানুষের নিরাপত্তা আপনারা দিতে পারেননি । আপনারা দিতে পারবেন না । শুধু রাজনীতি করেন রাজনীতিকে বিক্রি করে বেরান । রাজনীতি করতে গিয়ে দেশকে বিক্রি করবেন না ।’’ রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তানের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন মমতার মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন যে পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পরও কীভাবে রাষ্ট্রসংঘের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কমিটির নেতৃত্ব পেল পাকিস্তান ৷ ভারতের এই প্রতিবেশী দেশ কীভাবে আইএমএফ-এর ঋণ পাচ্ছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়৷ এই নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অবস্থান তাহলে কূটনীতিগতভাবে কি ছিল ! তাহলে কি আমরা কূটনীতিগতভাবে ফেল করলাম ? আমরা কি এর প্রতিবাদ করলাম না ? সন্ত্রাস করার পরেও কীভাবে পাকিস্তান আইএমএফ-এর লোন পায় ! আমেরিকার সাহায্য পায় কীভাবে !’’ এদিন এইসব ক্ষেত্রে দেশের কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন দেশের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর একজন ভালো মানুষ । তবে তিনি বলছেন, ‘‘এই জায়গাটায় নিজেদের মধ্যে কোনও কমিউনিকেশন গ্যাপ হচ্ছে না তো ! নিজেদের মধ্যে কোনও গ্যাপ হচ্ছে না তো, যার জন্য বহিরাগত শক্তি ঢুকছে ? কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও স্ট্রং হওয়া উচিত ।’’
error: Content is protected !!