
‘বাংলায় একসঙ্গে প্রচুর সংকট, ছড়িয়ে হিংসা ও অরাজকতা, মেয়েদের সুরক্ষার অভাব’, দাবি প্রধানমন্ত্রী মোদির
নির্বাচনের আগে রাজ্যে এসে পশ্চিমবঙ্গে ‘সংকটমোচনের’ প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৷ বাংলা বর্তমানে পাঁচটি সংকটের সম্মুখীন বলে দাবি করেন তিনি ৷ রীতিমতো পয়েন্ট আকারে সেই সব সংকটের কথা উল্লেখ করে তার থেকে মুক্তি পেতে বিজেপির প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানালেন মোদি ৷ সামনের বছরই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ৷ ফলে এদিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গ সফরে এসে তারই প্রস্তুতি শুরু করে দেবেন বলে চর্চা চলছিল রাজনৈতিক মহলে ৷ সেই মতোই বৃহস্পতিবার আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় শুরু থেকেই রাজ্যের শাসকদলকে নিশানা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ বর্তমানে রাজ্যে গুরুতর পাঁচ সংকট দেখা দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি ৷ তিনি বলেন, “আজ পশ্চিমবঙ্গে একসঙ্গে প্রচুর সংকট ৷ একটা সংকট সমাজে ছড়িয়ে পড়া হিংসা ও অরাজকতা ৷ দ্বিতীয়, মেয়েদের সুরক্ষার অভাব ৷ মা ও বোনেদের উপর জঘন্য অপরাধ চলছে ৷ তৃতীয় সংকট হল, বেকারত্বের কারণে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোর নিরাশা, চতুর্থ সংকট হল দুর্নীতি ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার স্বার্থপর রাজনীতির জন্য লাগাতার সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়েছে ৷ আর পঞ্চম, গরিবের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এখানকার শাসকদল ।” প্রথম ‘সংকটের’ কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী টেনে আনেন মুর্শিদাবাদ ও মালদার হিংসার প্রসঙ্গ ৷ তাঁর অভিযোগ, “মুর্শিদাবাদ ও মালদায় যা হচ্ছে, তা এখানকার সরকারের নির্মমতার উদাহরণ । তুষ্টিকরণের নামে গুন্ডাগিরিকে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছে ৷ যেখানে পার্টির লোক বিধায়করাই লোকেদের বাড়ি চিহ্নিত করে জ্বালিয়ে দেয়, আর পুলিশ তামাশা দেখে, তখন পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা বোঝা যায় ৷” দুর্নীতির প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারকে বিঁধতে প্রধানমন্ত্রীর হাতিয়ার ছিল মূলত শিক্ষা দুর্নীতি ও কাট মানির অভিযোগ ৷ সরাসরি না-হলেও তিনি ইঙ্গিত করেন চাকরিহারাদের পরিস্থিতির দিকে ৷ মোদি বলেন, “দুর্নীতির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ে গরিব ও যুব প্রজন্মের উপর ৷ শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতিতে কী হয়েছে আমরা দেখেছি ৷ তৃণমূল সরকার হাজার হাজার শিক্ষকের জীবন বরবাদ করে দিয়েছে ৷ ওদের পরিবার ও বাচ্চাদের অসহায় করে দিয়েছে এই নির্মম সরকার ৷ পশ্চিমবঙ্গের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে ৷ শিক্ষকের অভাবে লাখ লাখ বাচ্চার ভবিষ্যৎ ঝুলছে ৷ এত বড় অপরাধ করেছেন তৃণমূল নেতারা, আর তাঁরা আজও নিজেদের ভুল স্বীকার করতে রাজি নয় ৷ উলটে দেশের আদালতকে দোষ দিচ্ছে ৷” কেন্দ্রীয় জনকল্যাণকর প্রকল্পগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এ রাজ্যে চালু হতে না-দিয়ে বঙ্গবাসীকে আরও সংকটে ফেলে দিয়েছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী ৷ তাঁর দাবি, রাজনীতি করতে গিয়ে গরিব, দলিত, পিছিয়ে পড়া, আদিবাসী ও মহিলাদের সঙ্গে শত্রুতা করছে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ এরপরই আয়ুষ্মান ভারত, বিশ্বকর্মা প্রকল্প-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি এই সুবিধেগুলি থেকে রাজ্যবাসীকে বঞ্চিত করে রেখেছে তৃণমূল সরকার ৷ মোদির কথায়, “এসসি, এসটি, ওবিসিদের জন্য প্রকল্পগুলি রাজ্যে চালুই হতে দিচ্ছে না ৷ দেশের কোটি কোটি লোক আয়ুষ্মান যোজনায় চিকিৎসা পাচ্ছেন ৷ তবে এর ফায়দা বাংলার মানুষ পাচ্ছে না ৷ এখানকার কেউ দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই গেলে তিনি এই সুবিধে পান না ৷ নির্মম সরকার আয়ুষ্মান কার্ড দিতেই দেয়নি ৷ ৭০ বছরের উপরে প্রবীণদের পাঁচ লাখের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন ৷ আমি চাই পশ্চিমবঙ্গেও ৭০-এর উপর সব প্রবীণ বিনামূল্যে চিকিৎসা পান ৷ তৃণমূল সরকার এটা করতে দিচ্ছে না ৷ এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বকর্মা ভাই-বোন আছে ৷ এরা হাতের দক্ষতায় অনেক কাজ করতে পারে ৷ বিজেপি সরকার তাদের জন্য বিশ্বকর্মা প্রকল্প এনেছে ৷ দেশের লাখো লোক ট্রেনিং পেয়েছে, টাকা পেয়েছে, সহজ ঋণ পেয়েছে ৷ তবে পশ্চিমবঙ্গে আট লাখ আবেদন এখনও ঝুলে রয়েছে ৷ সরকার এই প্রকল্পকেও চালু করেনি ৷” এরপর আবাস যোজনার দুর্নীতির অভিযোগকে বিঁধে মোদি বলেন, “বিজেপি সরকার গরিব পরিবারকে পাকা ঘর দিচ্ছে ৷ পশ্চিমবঙ্গে লাখো পরিবারের ঘর তৈরি হচ্ছে না ৷ কারণ তৃণমূলের লোক এক্ষেত্রেও কাট মানি, কমিশন চাইছে ৷ আপনাদের নিয়ে এই সরকার কেন এত নির্মম ?” রাজ্য সরকার আদিবাসীদেরও বঞ্চিত করে রেখেছে বলে তোপ দেগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “আদিবাসীদের জন্য পিএম জনমন যোজনা তৃণমূল সরকার এখানে চালু করেনি, আদিবাসীদেরও বঞ্চিতই রাখছে ৷ আদিবাসীদের সম্মানের পরোয়া করে না তৃণমূল ৷ এনডিএ একজন আদিবাসী মহিলাকে যখন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করেন, তখন সবার আগে আপত্তি জানায় এই দল ৷” নীতি আয়োগের গভর্নিং কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর না যাওয়া নিয়েও এদিন সরব হন প্রধানমন্ত্রী ৷ গ্রাম সড়ক যোজনায় পশ্চিমবঙ্গে গ্রামগুলির জন্য চার হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কথা থাকলেও এখানে চারশো কিলোমিটার সড়কও হয়নি ৷ তাঁর অভিযোগ, “তৃণমূলকে তো ২৪ ঘণ্টা রাজনীতি করতে হয় ৷ দেশের বিকাশ তাদের কাছে গুরুত্বের বিষয় নয় ৷ এখানে 16টি বড় পরিকাঠামো প্রকল্প এখানকার সরকার আটকে রেখেছে ৷ ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রকল্প আটকে ৷ কোথাও মেট্রো, সড়ক, হাসপাতাল – সব আটকে রেখেছে ৷” সবশেষে রাজ্যের ‘সংকট’ দূর করতে বিজেপির উপর আস্থা রাখার কথা বলে গেলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি ৷ তিনি বলেন, “হিংসা, তুষ্টিকরণ, মহিলাদের উপর অত্যাচার, দুর্নীতির রাজনীতি থেকে এবার মুক্তি চাই । পশ্চিমবঙ্গের সামনে রয়েছে বিজেপি মডেল । আজ দেশে অনেক রাজ্যে বিজেপি রাজ্য চালাচ্ছে ৷ অসম হোক বা ত্রিপুরা, ওড়িশা – বিজেপি দ্রুত গতিতে বিকাশ করছে । বিজেপি কার্যকর্তাদের বলব, বাংলার সব পরিবারকে সুশাসন ও সমৃদ্ধির গ্যারান্টি দিতে হবে ৷ বিকশিত ভারত গড়তে হলে বাংলার বিকাশ চাই । বাংলার পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে ।”